বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:২০ অপরাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম ডেস্ক: ইউনেস্কোর নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ২০১৭ তে (ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ অফ হিউমিনিটি) তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটির বয়নশিল্প। বুধবার ইউনেস্কোর নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণের জন্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় কমিটি শীতলপাটির বয়নপদ্ধতির স্বীকৃতির ঘোষণা দিয়েছে। জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টা ৩২ মিনিটে ইউনেস্কো এ স্বীকৃতি দেয়।’
দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে বর্তমানে চলছে বিশ্বের নির্বস্তুক ঐতিহ্য সংরক্ষণার্থে গঠিত আন্তর্জাতিক পর্ষদের সম্মেলন। এই সম্মেলনের শেষ পর্বে উঠে এসেছে বাংলাদেশের সিলেটের ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প ‘শীতলপাটি’। জাতীয় জাদুঘরের সচিব মোহাম্মদ শওকত নবীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল এ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছে। প্রতিনিধি দলে রয়েছেন সিলেট অঞ্চলের দুই বিখ্যাত পাটিকর গীতেশচন্দ্র ও হরেন্দ্রকুমার দাশ। সম্মেলন স্থলে এই দুই পাটিকর তাদের বুননশৈলী উপস্থাপনা করছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া উন্নতমানের শীতল পাটি প্রদর্শন করা হচ্ছে সেখানে।
উল্লেখ্য, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটিকে ইউনেস্কোর Intergovernmental Committee for the Safeguarding of the Intangible Cultural Heritage এর ১২তম অধিবেশনে বিশ্বের নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য (The Intangible Cultural Heritage of Humanity) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য প্রস্তাবনা উত্থাপন করা হয়।
পাখি, ফুল, লতাপাতা, জ্যামিতিক নকশা, মসজিদ, চাঁদ, তারা, পৌরাণিক কাহিনীচিত্র, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার, শাপলা, পদ্ম; কী নেই? সুযোগ আছে প্রিয়জনের নাম লেখার। সিলেটের ঐহিত্যবাহী শীতলপাটিতে রয়েছে এ রকম নানা বৈচিত্র্য। এর আগে বাংলাদেশের বাউল সঙ্গীত, জামদানি বোনা ও মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেস্কোর এ তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
শীতলপাটির আকার-আকৃতিতে ও নকশায় রয়েছে বৈচিত্র্য। প্রদর্শনীতে দৈনন্দিন ব্যবহারের উপযোগী নানা ধরনের শীতলপাটি প্রদর্শিত হচ্ছে। বাংলাদেশের আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শন শীতলপাটি। মুর্তা বা বেতগাছের বেতি থেকে বিশেষ বুননকৌশলে শিল্পরূপ ধারণ করে এই লোকশিল্পটি।
জাতীয় জাদুঘরে শুরু হওয়া শীতলপাটি প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন সিলেট থেকে আসা শীতলপাটি শিল্পীরা। কথা হলো মৌলভীবাজার আসা আরও তিন শিল্পী রমাকান্ত দাশ, অজিত কুমার দাশ ও অরুণ চন্দ্র দাশের সঙ্গে। তারাও কথায় কথায় জানালেন শীতলপাটি তৈরির গল্প। তারা জানান, তাদের পুর্বপুরুষরা বন থেকে বেত যোগাড় করে পাটি বুনলেও এখন কিনতে হয় বেত। একটি শিতলপাটি বুনতে প্রায় দুইশো বেত প্রয়োজন হয়। কিন্তু দিন দিন বেত কমে যাওয়া আর অন্যান্য জিনিসের দাম বাড়ার ফলে নির্মাণ ব্যয় বেড়ে গেছে বহুগুণে। সেই তুলনায় বাড়েনি ক্রেতাদের আগ্রহ।
সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, বরিশাল, ঝালকাঠি, কুমিল্লা, ঢাকা, ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, টাঙ্গাইল ও নেত্রকোনায় এই গাছ পাওয়া গেলেও এই পাটির বেশির ভাগ শিল্পীই বৃহত্তম সিলেট বিভাগের বালাগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জের। সিলেট অঞ্চলের এই পাটির শতবর্ষী ঐতিহ্য রয়েছে।
এখানকার এক শ গ্রামের প্রায় চার হাজার পরিবার এই কারুশিল্পের সঙ্গে জড়িত। এই শিল্পীরা পাটিয়াল বা পাটিকর নামে পরিচিত। সিলেট অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী এই ‘শীতলপাটি’কে কেউ কেউ নকশি পাটিও বলে থাকেন। মৈমনসিংহ গীতিকা ও লোকসাহিত্যেও নানাভাবে উঠে এসেছে শীতলপাটির কথা। যারা এই পাটি বুনে থাকেন তাদের বলা হয় ‘পাটিয়াল’ বা ‘পাটিকর’।
একসময় ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়ায় শীতলপাটির ব্যাপক কদর ছিল। শীতলপাটি ভারতসম্রাজ্ঞী মহারানী ভিক্টোরিয়ার ব্রিটিশ রাজপ্রাসাদেও স্থান পেয়েছিল। ভারতবর্ষে আগমনের প্রমাণ ও স্মৃতিস্মারক হিসেবে ভিনদেশিরা ঢাকার মসলিনের পাশাপাশি সিলেটের বালাগঞ্জের শীতলপাটি নিয়ে যেতেন। কথিত আছে, দাসের বাজারের রূপালি বেতের শীতলপাটি মুর্শিদ কুলি খাঁ সম্রাট আওরঙ্গজেবকে উপহার দিয়েছিলেন।